বাংলার নবজাগরণ ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন
ইংরেজরা তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দেশীয়দের মধ্য থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একটি অনুগত শ্রেণি তৈরিতে মনোযোগ দেয়। ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর একটা বাড়তি লক্ষ্য ছিল চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে রাজ্য হারানো ক্ষুব্ধ মুসলমানদের সন্তুষ্ট করা। এরই ধারাবাহিকতায় হিন্দুদের জন্যে ১৭৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সংস্কৃত কলেজ। ইংরেজদের উদ্দেশ্য সাধনের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে স্থানীয় মানুষের মধ্যে নতুন চেতনার স্ফূরণ ঘটতে থাকে। বহুকালের প্রচলিত বিশ্বাস, সংস্কার, বিধান সম্পর্কে তাদের মনে সংশয় ও প্রশ্ন জাগতে থাকে। হিন্দু সমাজ থেকে সতীদাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে রীতিমতো আন্দোলন শুরু হলো, বিধবা বিবাহের পক্ষে মত তৈরি হলো। এদেশে এ সময় জ্ঞানচর্চায় সীমিত কিন্তু কার্যকর জোয়ার সৃষ্টি হয়। ইংরেজ মিশনারি স্যার উইলিয়াম কেরি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের কর্মভূমিকা ছাড়াও নানা সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তিনি বাংলা ব্যাকরণ রচনা, মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশ, স্কুল টেক্স্ট বোর্ড গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের পথ প্রদর্শন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইংরেজরা উচ্চ শিক্ষার জন্য সারাদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কিছু কলেজও স্থাপন করে। অবশেষে ১৮৫৭ সালে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮২১ সালে শ্রীরামপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনও বাংলার মানুষের মনকে মুক্ত করা ও জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আরেকটি পথ খুলে দেয়। এর ফলে বইপুস্তক ছেপে জ্ঞানচর্চাকে শিক্ষিত সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া ও স্থায়িত্ব দেওয়ার পথ সুগম হয়। এ সময় সংবেদনশীল মানুষের নজর যায় সমাজের দিকে । সমাজের অনাচার নিয়ে যেমন তাঁরা আত্মসমালোচনা করেছেন তেমনি শাসকদের অবিচারের বিরুদ্ধেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করে জনমত সৃষ্টিতে এগিয়ে আসে অনেকে ।
রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারে হাত দেন। ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর প্রমুখ অবাধে মুক্তমনে জ্ঞানচর্চার ধারা তৈরি করেন। বাংলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আধুনিক জ্ঞানচর্চার এই ধারা যুক্ত করতে নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলীর অবদান রয়েছে। আবার বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামের অবদানও ব্যাপক ।
বাঙালির এই নবজাগরণ কলকাতা মহানগরীতে ঘটলেও এর পরোক্ষ প্রভাব সারা বাংলাতেই পড়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামলের আধুনিক শিক্ষা ও জাগরণের আরেকটি দিক হলো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ। সেই সাথে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার বোধেরও উন্মেষ ঘটতে থাকে।
ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার পিছনে । যদিও ইংরেজ শাসকদের বক্তব্য ছিল দেশের কল্যাণ। এ সময় বাংলার সীমানা ছিল অনেক বড়। পূর্ববাংলা, পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে ছিল বৃহত্তর বাংলা। তাই কলকাতাকেন্দ্রিক ইংরেজ শাসকদের পক্ষে দূরবর্তী অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন ছিল। এ কারণে পূর্ব বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উন্নয়ন সম্ভব হয় নি। ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে প্রস্তাব রাখেন যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাকে দুইভাগে ভাগ করা হবে। ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ করা হবে। এই প্রদেশের নাম হবে ‘পূর্ব বঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ। একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর এই প্রদেশ শাসন করবেন।
যুক্তি থাকলেও বস্তুতঃ এর মধ্য দিয়ে বাংলায় ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে বিভক্ত করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য । বাংলাকে ভাগ করার মধ্যে দিয়ে ইংরেজ শাসকরা বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চেয়েছে বলে মনে করা হয় । কারণ, পূর্ববাংলার বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান । তাই মুসলমান নেতারা ভেবেছেন নতুন প্রদেশ হলে পূর্ব বাংলার উন্নতি হবে। কিন্তু শিক্ষিত হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। এ কারণে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বড় নেতাদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা মুসলমান নেতাদের সাথে পরামর্শ না করে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। ফলে মুসলমান নেতাদের মধ্যে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। তারা বুঝতে পারে মুসলমানদের দাবি আদায়ের জন্য তাদের নিজেদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ নামে মুসলমানদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের অভিসন্ধি অনেকটা সফল হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর থেকে দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা থেকে শাসকদের বিরত করার জন্য বাঙালি হিন্দু নেতারা একের পর এক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ ছিল ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো, শাসন করো' নীতির অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ।
স্বাধিকার আন্দোলন
বাঙালিরা বিনা প্রতিবাদে ইংরেজ শাসকদের কখনোই মেনে নেয় নি । গোটা ইংরেজ শাসনামল জুড়ে বাংলা ও ভারতে নানা প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে সর্বাগ্রে আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথা । সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম । দীর্ঘ সময় ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বঞ্চনা, নির্যাতন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং সর্বোপরি ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট হিসাবে কাজ করেছে। বাংলায় সিপাহি মঙ্গল পান্ডে ও হাবিলদার রজব আলী এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। সিপাহিদের এই বিদ্রোহে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের স্বাধীনচেতা শাসকরাও যোগ দেয়। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, মহারাষ্ট্রের তাঁতিয়া টোপি এরকমই কয়েকজন । দিল্লির বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরও এদের সমর্থন জানিয়েছিলেন।
১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলায় নানা আন্দোলন শুরু হয় । এর মধ্যে রয়েছে- স্বদেশী আন্দোলন, বয়কট আন্দোলন, স্বরাজ এবং সশস্ত্র আন্দোলন । স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিলেতি পণ্য, শিক্ষা বর্জন এবং দেশীয় পণ্য, শিক্ষা প্রচলনের মতো আরো নানাবিধ কর্মসূচি নেয়া হয় । এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জেগে উঠে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন । গড়ে ওঠে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির মতো বিপ্লবী সংগঠন। সশস্ত্র এই বিপ্লবী তৎপরতা ১৯৩০ এর দশক পর্যন্ত টিকে ছিল। বিপ্লবীদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, , মাষ্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকেই দেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। প্রীতিলতা ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ । পাশাপাশি বাংলাসহ ভারতব্যাপী জাতীয় পর্যায়ে চলেছিল নানাবিধ নিয়মতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন ইত্যাদি । জাতীয় পর্যায়ের এসব আন্দোলনে যুক্ত বাঙালি নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন নেতাজি সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রমুখরা । মনে রাখতে হবে, অন্যান্য কারণ থাকলেও নানা ধরনের ধারাবাহিক এসব আন্দোলন ও সংগ্রামের চাপেই ব্রিটিশরা এদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল ।
Read more